পীরগাছা উপজেলা পরিষদ থেকে পূর্ব দিকে ১/২ কিলোমিটার
পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনা পীরগাছা মন্থনা দেবী চৌধুরানীর বাড়ি
রংপুরের ফতেহপুর চাকলার মন্থনা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা অনন্তরাম কোচবিহার মহারাজার একজন কর্মচারী ছিলেন। তিনি একজন বারেন্দ্রীয় ব্রাহ্মণ। ১৭০৩-১৭০৪ খ্রিঃ দিকে কোচবিহার মহারাজা রুপনারায়নের শাসনকালে রংপুরের পীরগাছা এলাকায় একটি ছোট্ট তালুক লাভ করেন। তার নামানুসারে উক্ত তালুক (গ্রাম) খানির নামও অনন্ত রাম হয়। আরেক সুত্রে জানা যায় অনন্তরাম এ বংশের ষষ্ঠ পুরুষ ছিলেন এবং বৈষ্ণব মিশ্র নামে একজন মৈথিলী ব্রাহ্মণ কোচবিহার মহারাজার দ্বারা পুরোহিত এ জমিদারির আদি পুরুষ ছিলেন। তারই বংশের চতুর্থ পূরুষ জিতুমিশ্র এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। অনন্তরামের পূর্ব পূরুষ সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানা যায় না। ১৭১১ সালের দিকে যখন মোগল বাহিনী ‘কাছওয়ারা' (সরকার কোচ বিহার) দখলে তৎপর হয়ে ওঠে তখন অন্যান্য কোচ কর্মচারীদের মতো অনন্তরামও মোগল পক্ষে যোগদান করে মন্থনা জমিদারিতে তার পূর্বপদ বহাল রাখেন। তার প্রতিষ্ঠিত জমিদারি পরবর্তীকালে মন্থনা অথবা দু আনা ফতেহপুর বলে আখ্যা লাভ করে। তদীয় পুত্র যাদবেন্দ্র নারায়ন একজন খ্যাত নামা বৈষ্ণব অনুসারী ছিলেন এবং যাদব রায় ও গোপাল নামে দুটি পারিবারিক বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করে এক দেবোত্তর এষ্টেট
প্রতিষ্ঠা করেন। যার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৩০,০০০/- টাকা। এছাড়াও তিনি ধর্ম প্রাণ ব্রাহ্মণদের জন্য বহু সম্পত্তি দান করেন। যাদবেন্দ্র রায়ের পুত্র রাঘবেন্দ্র নারায়ন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে রাঘবেন্দ্রের পুত্র নরেন্দ্র ১৭৬৫ খ্রিঃ উত্তরাধিকারবিহীন অবস্থায় মারা গেলে মৃত জমিদারের স্ত্রী জয় দুর্গা দেবী প্রায় তিন দশকের মত মন্থনা জমিদারি পরিচালনা করেন। এই জয়দুর্গা দেবীই ইতিহাসে খ্যাত নামা দেবী চৌধুরাণী নামে পরিচিত। যিনি তার জীবদ্দশার অধিকাংশ সময় রংপুরের প্রজা বিদ্রোহীদের সাথে জড়িত ছিলেন। এ সময় সন্নাসী বিদ্রোহের নেতা ভবানী পাঠক এর সাথে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে রংপুর কালেক্টর রিচার্ড গুডল্যাণ্ড ও সেনা কমাণ্ডার লেঃ ব্রেনান বেসামাল হয়ে পড়ে। রংপুরসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারেও উক্ত বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে। বৃটিশদের অত্যাচারে দেবী চৌধুরাণী অবশেষে আত্মগোপন করে নিজ গোমস্তার মাধ্যমে জমিদারী পরিচালনা করেন। তার অনুপস্থিতির সুযোগে কোম্পানী সরকার তার পরগণায় রাজস্ব আদায়ের জন্য সাজোয়াল নিযুক্ত করে। এর ফলে নিরীহ প্রজাদের উপর অত্যাচার বৃদ্ধি পায়। দেবী চৌধুরাণী কত দিন নিরুদ্দেশ ছিলেন এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দুটি মতামত রয়েছে।একদল ঐতিহাসিকদের মতে ১৭৮৩ সালের বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহের প্রথম বৃহস্প্রতিবার বিদ্রোহীদের গোপন আস্থানার সন্ধান পেয়ে বৃটিশবাহিনী চজন্ডীপুর গ্রামে( নাপাই চন্ডী) ইংরেজবাহিনী আচমকা আক্রমন শুরু করে। পীরগাছার মন্থনার জমিদার জয় দুর্গা দেবী(দেবী চেীধুরানী) ইংরেজরদের বিরুদ্ধে বির বিক্রমে যুদ্ধ করে এখানে নিহত হন।তার সাথে নিহত হন ইটাকুমারীর মানবপ্রেমী জমিদার শীভ চন্দ্র রায় এবং দেবী চৌধুরানীর ছোট ভাই কেষ্ট কিশোর চৌধুরীসহ অসংখ্য ফকির সন্ন্যাসী।অন্য একটি মতের অনুসারীরা মনে করেন, ফকির সন্ন্যাস প্রজা বিদ্রোহ প্রশমিত হলে দেবী চৌধুরানী নিজ জমিতে ফেরত আসেন।
মন্থনা জমিদার বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ -এর একাংশ
সরকারী এক সুত্রে জানা যায়, ১৭৯১ খ্রিঃ ১৯ অক্টোবর রংপুর জেলার বাতিলকৃত জমিদার বৃন্দের যে তালিকা প্রকাশিত হয় তার মধ্যে জয়দুর্গা দেবীর নাম পাওয়া যায়। তাতে মনে হয় ফকির সন্নাসী বিদ্রোহের আগুন প্রশমিত হলে ১৭৯০ খ্রিঃ আগে আগেই তিনি নিরুদ্দেশ জীবন কাটিয়ে নিজ জমিদারিতে পূর্ণ মর্যাদায় ফেরত আসেন। এ কারণেই বাতিলকৃত জমিদারের তালিকায় তার নাম প্রকাশ হয়েছিল। অপর দিকে ১১৭৬ বঙ্গাব্দ (১৭৬৯-৭০ খ্রিঃ) থেকে ১১৯৭ বঙ্গাব্দ (১৭৯০-৯১খ্রিঃ) পর্যন্ত সময় কমপক্ষে তিনি যে মন্থনার জমিদার ছিলেন তা তার প্রদত্ত দুই খানি সনদ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। উক্ত সনদের একখানি পীরপাল (১১৭৬ বঙ্গাব্দের ৫ই মাঘ) এবং অপরটি মুশকালী চুকানী পাট্টা (১১৯৭ বঙ্গাব্দ, ২৫ কার্তিক) উপরি উক্ত পাট্টা দু খানিতে তার জমিদারি শুরু ও শেষ জানা যায় না। তবে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে তিনি সুদীর্ঘকাল মন্থনা পরগনার জমিদার ছিলেন এবং দেবী চৌধুরাণী নামে পরিচিত । তিনি যে মন্থনার জমিদার এ কথা ঐতিহাসিক সত্য। জয় দুর্গার মৃত্যুত তার দত্তক পুত্র রাজেন্দ্র নারায়ন রায়
চৌধুরী মন্থনার জমিদার হন এবং বুকানন রংপুরে আগমন কালেও ১৮০৮-০৯ খ্রিঃ তিনি মন্থনার জমিদার পদে বহাল ছিলেন। তার মৃত্যুর পর মন্থনা জমিদারী তাঁর দু পুত্র হরেন্দ্র নারায়ন (বড় তরফ) ও ভৈরবেন্দ্র নারায়ন (ছোট তরফ) এর মধ্যে বিভক্ত হয়। বড় তরফ তৌজি নং ১৯ এবং ছোট তরফ ২০নং তৌজি লাভ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে জমিদার জগদিন্দ্র নারায়ন দেনার দায়ে ছোট তরফের অধিকাংশ অংশ তাজহাটের মহারাজ গোবিন্দ লালের কাছে বিক্রয় করে দেন। বাকী অংশটুকুও তদীয় পুত্র হেমেন্দ্র নারায়ন বিক্রি করে দিলে মন্থানার ছোট তরফের অস্তিত্ব লোপ পায়। বড় তরফের জমিদার হরেন্দ্র নারায়নের পুত্র মহেন্দ্র নারায়ন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তদীয় স্ত্রীর দত্তক পুত্র জ্ঞানেন্দ্র নারায়ন বড় তরফের জমিদারীর অধিকারী হন। তিনি নিজ অংশের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। ১৩০৫ বঙ্গাব্দে তিনি মারা গেলে তদীয় ধর্মপরায়ণা স্ত্রী ভবতারিনী দেবী ১৩৩০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত উক্ত জমিদারী পরিচালনা করেন। তার নিজ নামে নির্মিত ভবতারিনী কালীমন্দির অটটু অবস্থায় বড় তরফ জমিদার বাড়িতে দাড়িয়ে আছে। তার মৃত্যুর পর তদীয় দত্তক পুত্র ভুপেন্দ্র নারায়ন ছিলেন এই পরিবারের শেষ জমিদার। যার সময় ১৯৫০ খ্রিঃ জমিদারী প্রথা বিলুপ্তি আইন পাশ হয় । রংপুরের পীরগাছা থানার ও রেল ষ্টেশনের অনতিদুরে এ জমিদার বাড়ি অবস্থিত। ধ্বংস প্রায় জমিদার বাড়ির কাঁচারী বাড়ি আজও পীরগাছা থানা রেজিষ্ট্রি অফিস। জমিদার বাড়ির মধ্যে নির্মিত বহু মন্দির আজ আর নেই । তবে ছোট তরফের জমিদার ভৈরবেনন্দ্র নারায়ন কর্তৃক নির্মিত ত্রিবিগ্রহ মন্দির আজও ধ্বংসের অপেক্ষায় দিন গুণছে। এখানে অন্নপূর্ণা বিশেশ্বর, শিব ও হরিহর তিনটি বিগ্রহ এক মন্দিরের পাশাপাশি কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে। যা বাংলার মন্দির স্থাপত্যের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত । ঐতিহাসিক দেবী চৌধুরানী পীরগাছার মন্থনা জমিদার ছিলেন এটাই সত্য। দেবী চৌধুরানী ভারতবর্ষের প্রথম রানী যিনি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষন, নিপিড়ন এবং নিষ্ঠুর প্রজাপিরনের বিরুদ্ধে ফকির সন্ন্যাস এবং কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছেন।আত্ববিস্তৃতির অন্ধকারে দেবী চৌধুরানী বাড়ি, আস্থানা,স্মৃতি নিদর্শন সবকিছুই আজ বিলুপ্তের পথে।পীরগাছায় মন্থনার জমিদার জমিদার বাড়ি, দৃষ্টিনন্দিত পুকুর, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, নাপাই চন্ডীর মেলা প্রন্তর এগুলোকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং পর্যটন শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করা গেলে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। এতে একদিকে বিপুল অর্থাগম ঘটবে এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইতিহাস ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটবে।
সম্ভাবনাঃ পীরগাছা ইউনিয়নের ২০১১ সালের আদমশুমারী তথ্য অনুযয়ী লোকসংখ্যার প্রায় ৬০,০০০ এই জনসংখ্যার মধ্যে তরুনযুবকের সংখ্যা ৩৭,০০০ প্রায়। মানব সম্পদ উন্নয়নে এই তরুন যুবকরাই আশা ভরশার স্থল।বর্তমান যুগ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগ।এই যুগকে অবোগহন করতে হলে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত বিকাশ জরুরী।অমৃত সম্ভাবনাময় পীরগাছা ইউনিয়নের যুব শক্তিকে মানব সম্পদে পরিতন করতে হবে।আত্বকর্মসংস্থানের বিকাশ ঘটাতে পারলে বেকারত্ব লাঘব হবে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস